ঢাকা , বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫ , ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মান্দায় বেশি দামি হয়ে উঠছে নামজারি সেবা

ভূমি কর্মকর্তা মো. রহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ও হয়রানির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০২-১১-২০২৫ ০৩:৪৯:৪৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০২-১১-২০২৫ ০৩:৪৯:৪৭ অপরাহ্ন
ভূমি কর্মকর্তা মো. রহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ও হয়রানির অভিযোগ নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ও কাঁশোপাড়া ইউনিয়নে নামজারি ও ভূমি সংক্রান্ত কাজে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না এমন অভিযোগে জর্জরিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিস। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা (নায়েব) মো. রহিদুল ইসলাম, যিনি সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন এবং টাকা না দিলে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ও কাঁশোপাড়া ইউনিয়নে নামজারি ও ভূমি সংক্রান্ত কাজে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না এমন অভিযোগে জর্জরিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিস। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা (নায়েব) মো. রহিদুল ইসলাম, যিনি সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন এবং টাকা না দিলে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

২০২৫ সালের ১৬ এপ্রিল উপ-সহকারী ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম, ঘুষ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগ উঠছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, “আমি আন্তরিকভাবে কাজ করি, মানুষকে সহযোগিতা করি। ঘুষ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।” কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। এলাকাবাসীর মতে, প্রসাদপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস এখন যেন এক ‘ঘুষের বাজার’।

নামজারির কাজে ২৫ হাজার টাকার ঘুষ দাবি : মান্দা উপজেলার পার-ইনায়েতপুর গ্রামের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল হোসেন মাস্টার সম্প্রতি নিজের জমির তিনটি নামজারি কাজের জন্য আবেদন করেন। তার অভিযোগ, ওই কাজের জন্য রহিদুল ইসলাম তার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরে উপজেলা ভূমি অফিসের নামে আরও সাড়ে সাত হাজার টাকা দাবি করেন। আবুল হোসেন বলেন, “আমি ৭ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু বাকি ৫০০ টাকা দিতে না পারায় তিনি রাগ করে বলেন, ‘এটা উপজেলা অফিসে দিতে হবে, না দিলে কাজ হবে না।’ টাকা না দিলে ফাইল আটকিয়ে রাখেন। শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে কাজ শেষ হয়।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, টাকা নেওয়ার পরও রহিদুল ইসলাম বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন— বারবার কাগজপত্র ফেরত পাঠানো, নতুন করে ফি দাবি, এমনকি জমির খতিয়ান বদলে দেওয়ার হুমকিও দেন।

প্রসাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মণ্ডল বলেন, “এই ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে বলে, নামজারির জন্য টাকা চাওয়া হয়েছে বা হয়রানি করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই ভূমি অফিস, তাই মানুষের কান্না চোখে দেখা যায়। প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।” চেয়ারম্যানের মতে, ভূমি অফিস এখন জনসেবার জায়গা না হয়ে ঘুষ বাণিজ্যের আখড়াতে পরিণত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রাপ্য সেবা না পেয়ে বাধ্য হচ্ছে ঘুষ দিতে, যা প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিচায়ক।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. রহিদুল ইসলাম বলেন, “আবুল মাস্টার আমার বাবার মতো মানুষ। আন্তরিকভাবে তার কাজ করেছি।” তবে ঘুষ নেওয়া বা অতিরিক্ত টাকা দাবি করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যান। পরে দেখা করার প্রস্তাব দেন, যা স্থানীয়দের কাছে ‘প্রচলিত এড়ানোর কৌশল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিনি প্রায়ই অভিযোগকারীদের ‘সমঝোতার’ প্রস্তাব দেন বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে বিষয়টি থামানোর চেষ্টা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মান্দা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাবিল নওরোজ বৈশাখ বলেন, “নামজারির নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ এখনো আমার জানা নেই। তবে কেউ যদি এমন অভিযোগ করে থাকেন, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে স্থানীয়দের দাবি, এসব অভিযোগের বেশিরভাগই ‘মৌখিক’ থেকে যায়। সাধারণ মানুষ ভয়ে লিখিত অভিযোগ করতে সাহস পান না, কারণ তারা মনে করেন অভিযোগ দিলে তাদের ভবিষ্যতের ফাইল আটকে যাবে। মান্দা উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের মতোই প্রসাদপুর ও কাঁশোপাড়া ইউনিয়নেও নামজারি, খাজনা, হালনাগাদ বা দখলীয় খতিয়ান সংগ্রহের মতো কাজগুলো ঘুষ ছাড়া সম্ভব নয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। প্রসাদপুর ইউনিয়নের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “আমার বাবার নামে খতিয়ান আছে। তার মৃত্যুর পর নামজারি করতে গেলে কর্মকর্তা ১৫ হাজার টাকা চান। সরকার নির্ধারিত ফি তো মাত্র কয়েকশ টাকা। এত টাকা কোথা থেকে দেব?”

আরেক সেবাগ্রহীতা হাসান আলী বলেন, “আমি প্রথমে ভাবছিলাম অফিসে গিয়ে সরকারি ফি দিয়ে কাজ করব। কিন্তু অফিসের পিয়নই আগে বলে দিল, ‘স্যারকে না দিলে কাজ হবে না।’ এরপর বুঝলাম— এখানে নিয়ম নয়, ঘুষই আইন।”
ভূমি সেবায় ডিজিটাল যুগেও পুরনো দুর্নীতি : সরকার ২০২৩ সালে সারাদেশে “ডিজিটাল ভূমি সেবা” চালু করে— যার মাধ্যমে নামজারি, খাজনা ও রেকর্ড সংশোধন অনলাইনে করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনে সেই উদ্যোগ তেমন কাজে আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মান্দা উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অনলাইনে আবেদন করলেও ফাইল শেষে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার টেবিলেই আসে। সেখানে ঘুষ ছাড়া অনুমোদন পাওয়া খুব কঠিন। কারণ মাঠপর্যায়ে যে রিপোর্ট দিতে হয়, সেটা ওই কর্মকর্তার হাতে।” তিনি আরও বলেন, “উপরের কর্মকর্তারা জানেন কিন্তু লিখিত প্রমাণ না থাকলে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।”

ঘুষ গ্রহণ বা অর্থ দাবি করা সরকারি কর্মচারীর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ ও দণ্ডবিধি ১৬১ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় ঘুষ নেওয়া বা প্রলোভন দেওয়ার জন্য ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, দেশে ভূমি সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি আসে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, দুদকে জমা হওয়া মোট অভিযোগের ৩২ শতাংশ ভূমি অফিস সম্পর্কিত। দুদকের সাবেক পরিচালক (গোপন অনুসন্ধান) একে এম ফজলুল হক বলেন, “নামজারির মতো সেবা ঘুষের ফাঁদে পড়ায় সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পায় না। যদি স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর নজরদারি ও ডিজিটাল ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করা যায়, তাহলে এমন অপরাধ কমবে।” মান্দা উপজেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের সদস্যরা বলছেন— ভূমি সেবা মানুষের মৌলিক নাগরিক অধিকার। অথচ সেই অধিকার এখন ‘ঘুষের খাতায় বন্দি’। সাবেক শিক্ষক মো. আতাউর রহমান বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আজ দেখছি সাধারণ কৃষককে জমির মালিক হতে ঘুষ দিতে হয়। এটা লজ্জার।”

স্থানীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রশাসন চাইলে তিন দিনের মধ্যে সত্য বের করা সম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব আর অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের কারণে এসব কর্মকর্তা রেহাই পেয়ে যান।” স্থানীয়দের অভিযোগ- ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তারা একা কাজ করেন না; তাদের পেছনে আছে একটি অদৃশ্য ‘দালাল সিন্ডিকেট’, যারা অফিসের বাইরে বসে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা আগেই আবেদনকারীর কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে ফাইল তৈরি করে, পরে বলে— “স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে, একটু কিছু দিতে হবে।” সাধারণ মানুষ মনে করেন, টাকা দিলে কাজ দ্রুত হয়, তাই তারা নিরুপায় হয়ে দেন।

একজন দালাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “স্যাররা তো আমাদের কিছু বলেন না। আমরাই তাদের জন্য কাজ করি। যা পাই, ভাগাভাগি হয়। এটা ওপেন সিক্রেট।” স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে ঘুষ-দুর্নীতি চললেও কার্যকর নজরদারি না থাকায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযানের ঘোষণা দিলেও তা কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে। নওগাঁ জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “একটা ঘুষের অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। সাক্ষী পাওয়া যায় না। অনেক সময় ঘুষদাতা নিজের দায় এড়াতেও নীরব থাকে।”

মান্দার মানুষ এখন প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে আছে একজন ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার হাতে যেন পুরো ব্যবস্থার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেটাই তাদের প্রত্যাশা। নামজারির মতো সাধারণ নাগরিক সেবায় যদি মানুষকে ঘুষ দিতে হয়, তবে উন্নত সেবা বা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন কেবল কাগজেই থেকে যাবে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল বারেকের ভাষা- “মানুষ এখন সরকারি অফিসকে ভয় পায়। যতদিন ঘুষের সংস্কৃতি চলবে, ততদিন উন্নয়ন কেবল ভাষণেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”


নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ