সাধন-কামরুলের পথে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও- ২
চাল লুটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে খবর ফাঁসের দায় চাপিয়ে নিরপরাধ কর্মকর্তাকে শাস্তির নির্দেশ দিলেন আলী ইমাম মজুমদার
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৮-১১-২০২৫ ১২:৪০:৫৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৮-১১-২০২৫ ১২:৪০:৫৮ অপরাহ্ন
আলী ইমাম মজুমদার
সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের বিগত সংখ্যার “সাধন-কামরুলের পথে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সাম্প্রতিক গুরুতর অনিয়মের একটি নজির বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে প্রমাণসহ এই মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপদেষ্টা আলী ইমাম মজমুদার আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলের মন্ত্রীদের পথেই হাঁটছেন নিজের আখের গোছানোর ধান্দায়। এরকমের অনেক নজির রয়েছে। একটি ঘটনা পুরোপুরি তুলে ধরা ছাড়াও আরেকটি ঘটনার বিবরণ শুরু করা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে। দ্বিতীয় যে ঘটনাটির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল তা ছিল কুমিল্লার একজন উপজেলা খাদ্য পরিদর্শকের গাজীপুরে পদায়ন বিষয়ে।
মুহাম্মদ এনামুল হক নামের কুমিল্লা চান্দিনার ওই উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক আবেদনে বলেছিলেন, তার মা-বাবা গাজীপুরে থাকে। তাই খাদ্য অধিদপ্তরের তখনকার ডিজি আব্দুল খালেক উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক এনামুল হকের আবেদন খতিয়ে দেখতে গাজীপুরের ডিসি ফুড- কে দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু ডিসি ফুড এর তদন্তে দেখা গেলো, এনামুল হকের মা-বাবা গাজীপুরে নয়, চান্দিনায়ই থাকেন। ডিজি আব্দুল খালেক তখন মিথ্যা তথ্যে আবেদনের দায়ে এনামুল হককে জয়দেবপুরের ওসি এলএসডির পরিবর্তে গাজীপুরের ডিসি ফুড কার্যালয়ে সংযুক্তিতে পদায়ন করেন। এনামুল হক এতে মহা বেকায়দায় পড়ে যান। আকর্ষণীয় পদের লোভ করতে গিয়ে উল্টো শাস্তি হয়ে গেলো তার, ৪০ লাখ টাকা তো জলে গেলো-ই। উপদেষ্টার ছেলে টিপুর কাছে ঘুষের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ধর্না দেন তিনি। টিপু তার বাবার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। মহাক্ষুব্ধ হন উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ডিজির ওপর। ডিজি আব্দুল খালেক সঠিক পথে থাকতে গিয়ে উপদেষ্টার রোষানলে পড়েন। নানা ছুতোয় ডিজির ওপর বেশ কয়েকদিন ক্ষোভও ঝাড়েন উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। আব্দুল খালেককে ডিজি পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টাও চালান। পরবর্তীতে আব্দুল খালেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে চলে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন উপদেষ্টা। বর্তমানে যিনি অধিদপ্তরের ডিজি পদে এসেছেন মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর আওয়ামী দোসর হিসেবে পরিচিত। তবে এখন তিনি বোল পাল্টে জামায়াত হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন, যদিও আওয়ামী লীগ আমলে শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারতে নেতৃত্বদানের প্রমাণ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। উপদেষ্টা আলী ইমামই পছন্দ করে হুমায়ুনকে খাদ্যের ডিজি পদে পদায়নের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে যে কোনো অপকর্ম তাকে দিয়ে করানো যায় এবং তিনি করছেনও।
দুর্নীতির খবর কীভাবে ফাঁস হলো, ক্ষুব্ধ উপদেষ্টা
গত বছরের শেষের দিকের ঘটনা এটি। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চাল খালাসের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে চাল আত্মসাতের গুরুতর ঘটনায় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন খবরটি গণমাধ্যমে আসায়। উপদেষ্টার ক্ষোভ হলো, চাল আত্মসাতের ঘটনাটি কীভাবে ফাঁস হলো এ নিয়ে, চাল আত্মসাত নিয়ে নয়। তিনি চাল আত্মসাতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এ খবর ফঁাঁসের জন্য দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে খুঁজে বের করতে নিদেশ দেন। এক্ষেত্রে খবর ফাঁসের জন্য কাল্পনিকভাবে দায়ী করা হয় চট্টগ্রামের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সুনীল দত্তকে পরবর্তীতে তদন্তে যাকে নিরাপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো রকমের প্রমাণ ছাড়া এমনকি তদন্ত ছাড়াই সুনীল দত্তকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার জন্য নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। খাদ্য অধিদপ্তরের তখনকার ডিজি আব্দুল খালেক এ ধরনের অন্যায় পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন উপদেষ্টাকে। কিন্তু উপদেষ্টা নাছোড়বান্দা। ফলে ডিজি বাধ্য হন সুনীল দত্তকে তার পদ থেকে প্রত্যাহার করে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করতে। এরপরও সুনীল দত্তকে সাসপেন্ড করতে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ডিজির ওপর চাপ দিতে থাকেন। তিনি তা করেননি। বরং চাল আত্মসাতের খবর ফাঁসের সঙ্গে সুনীল দত্ত আদৌ জড়িত আছেন কিনা তা খতিয়ে দেখতে ডিজি আব্দুল খালেক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। উপদেষ্টার অনুমতি নিয়েই তিনি এ তদন্ত কমিটি গঠন করেন। চাল আত্মসাতের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে খবর ফাঁসের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তদন্ত কমিটি গঠন! যদিও এটি সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক তারপরও ডিজি এ কাজটি করেন উপদেষ্টার অন্যায় রোষানল থেকে সুনীল দত্তকে বাঁচাতে গিয়ে। পরবর্তীতে তদন্তেও প্রমাণিত হয়, গণমাধ্যমে খবর ফাঁসের সঙ্গে সুনীল দত্ত মোটেই জড়িত নন। সম্প্রতি সুনীল দত্তকে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি), রাঙ্গামাটি পদে পদায়ন দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর তাকে এই পদায়ন দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে আমদানি করা চাল ওজনে কম দিয়ে আত্মসাৎ করার আগেই তিন ট্রাক (প্রায় ৭২১ বস্তা) আমদানির চাল আটকে দেয় চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস। দেশের সেন্ট্রাল সাপ্লাই ডিপো-সিএসডি ও লোকাল সাপ্লাই ডিপো-এলএসডিতে ওজনে কম দিয়ে এসব চাল আত্মসাতের চেষ্টা করছিলেন খাদ্য বিভাগের চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গত ২৬ ডিসেম্বরের ঘটনা এটি। চট্টগ্রাম চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) জ্ঞানপ্রিয় বিদূর্শী চাকমাসহ অন্য কর্মকর্তারা তিন ট্রাক চাল বন্দর থেকে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা এসব ট্রাক আটকে দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের ঊর্ধ্বতন খাদ্য কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আমলে। সেই সিন্ডিকেট এখনো বহাল-তবিয়তেই আছে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ছত্রছায়ায়। চট্টগ্রামের আরসি ফুড এস এম কায়ছার আলী এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন। অন্য দুজন হলেন- চট্টগ্রামের ডিসি ফুড সুমাইয়া নাজনীন এবং চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক জ্ঞানপ্রিয় বিদূর্শী চাকমা। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, এরা প্রত্যেকেই অন্ততঃ শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আওয়ামী আমলে দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে। বন্দরে চাল আত্মসাতের ঘটনা চাপা দিতে গিয়ে এরাই মূলতঃ গণমাধ্যমে খবর ফাঁসের দায় সুনীলের ওপর চাপিয়েছেন।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এস এম কায়ছার আলী সাধন চন্দ্র মজুমদারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। নীতিমালার চরম ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার তাকে কুমিল্লার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দীর্ঘকাল ধরে ডিসি ফুড পদে রাখেন। এবং সেখান থেকে সরাসরি চট্টগ্রামের আরসি ফুড পদে পদায়ন করেন সাধন চন্দ্র মজুমদার মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। এস এম কায়ছার আলীর বাড়ি চট্টগ্রাম শহরে। সেই হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী কায়ছার আলী চট্টগ্রামের আরসি ফুড পদে পদায়ন পাওয়ার যোগ্য নন। কিন্তু সাধন চন্দ্র মজুমদার মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কায়ছার আলীকে চট্টগ্রামের আরসি ফুড পদে পদায়ন করেন। চট্টগ্রামের আরসি ফুড পদে পদায়নেরও এখন ইতিমধ্যে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নীতিমালা অনুযায়ী অন্যত্র বদলির সময় হয়ে এলেও উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে তিনি চট্টগ্রামেই থেকে যাচ্ছেন। সাধন চন্দ্রের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা এই কায়ছার আলী উপদেষ্টা আলী ইমাম এবং তার ছেলে টিপুরও অত্যন্ত প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ কায়ছার আলী এখন নিজেকে জামায়াত বলে পরিচয় দিচ্ছেন। কায়ছার আলীর রাতারাতি এমন বোল পাল্টানোর ঘটনায় খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হতবাক হচ্ছেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স