‘রিজার্ভ হিরো’ সাবেক ডেপুটি গভর্নর
কোথায় আছেন ভুয়া ‘রিজার্ভ হিরো’ সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর?
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৯-১১-২০২৫ ১২:১৪:৫৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৯-১১-২০২৫ ১২:১৪:৫৯ অপরাহ্ন
সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর?
এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ‘রিজার্ভ হিরো’ খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান। ব্যাংক পাড়ায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিশ^স্ত এবং আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারের সুনজর পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এমন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি।
অভিযোগ রয়েছে, কাজী সাইদুর জনগনের চোখে ধুলা দিয়ে এবং শেখ হাসিনাকে খুশি করতে রিজার্ভের প্রকৃত তথ্য গোপন করে তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতেন। জানা যায়, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ডলারের দাম আটকে সরকারি এবং বেসরকারি বিদেশি ঋণের অর্থ রিজার্ভে যুক্ত করে দেখাতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। কাঙ্খিত পদ পাওয়ার আশায় এসব প্রতারণার আশ্রয় নিতেন কাজী সাইদুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কোন বিষয়ে তিনি কথা বলতে না চাইলেও রিজার্ভের তথ্য প্রচারের ব্যাপারে ছিলেন অগ্রগামী। এজন্য একসময় তাকে ‘রিজার্ভ হিরো’ বলা হতো।
দেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় ২০২১ সালের আগস্টে। তখন তিনি সাংবাদিকদের মোবাইলে এসএমএস করে প্রতিনিয়ত সেই তথ্য পাঠাতেন। কিন্ত পরবর্তীতে জানা যায়, কাজী সাইদুরের দেখানো রিজার্ভের এই অংক ছিল প্রতারণা। প্রকৃত তথ্য গোপন করে সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণ রিজার্ভে যুক্ত করে তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতেন।
গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমানসহ ৬ জন শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। সহকর্মী কর্মকর্তাদের ক্ষোভে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ সময় সেনাসদস্যদের নিরাপত্তায় চার ডেপুটি গভর্নর এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের দাবির মুখে পদত্যাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যান।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের সহযোগী ছিলেন তিনি। কাজী সাইদুরের দুর্দশা শুরু আরো আগে থেকে। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং দুটি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছর জড়িত থাকায় ডলার কেনাবেচা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মূল্য নির্ধারণে তার একক কর্তৃত্ব তৈরি হয়েছিল। ডলার সংকট তীব্র হলে তার সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে তখনকার গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাকে সরিয়ে দেন।
খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, কাজী সাইদুরের রিজার্ভ কারসাজির ফলে পরবর্তীতে অর্থনৈতিকভাবে বড় বিপাকে পড়ে দেশের অর্থনৈতিক খাত। অভিযোগ রয়েছে, তার নয়-ছয়ের ফলে করোনা পরবর্তী রিজার্ভ আরও বেড়ে যায়। এটাই দেশের অর্থনীতির জন্য পরে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাস্তবতা অনুযায়ী যদি ডলারের দাম আগে সমন্বয় করা হতো, তবে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে এত বিপাকে পড়তে হতো না। অবশেষে ২০২৪ সালে এসে বাধ্য হয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়, যদিও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে তিন বছরের ব্যবধানে সেই রিজার্ভ কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একাধিক অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণ মিলে এ পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বরের হিসাবে এখন দেশের গ্রস রিজার্ভ ৩১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি (বিপিএম-৬)।
২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠা রিজার্ভ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে অর্ধেকে নেমে আসে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা বড় কারণ হিসেবে বলছেন, কোভিড-পরবর্তী আমদানির চাপ ও জ্বালানি-খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধি; বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ; রেমিট্যান্স প্রবাহে শ্লথ গতি ও হুন্ডির প্রভাব ও রপ্তানি আয়ে স্থবিরতা।
রিজার্ভ ফুলিয়ে দেখানোর প্রমাণ মেলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনে। ২০২১ সালের অক্টোবরে আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৭.২ বিলিয়ন ডলার বেশি দেখিয়েছে। ২০২১ সালের খসড়া সুরক্ষা মূল্যায়নে বিদেশি সম্পদের ভুল শ্রেণিবিন্যাস ধরা পড়ে। এতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে রিজার্ভ ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি।
দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো আমদানির আড়ালে অর্থপাচার। অনেক আমদানিকারক প্রকৃত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে পণ্য দেখিয়ে এলসি খোলেন। যেমন ৫ ডলারের পণ্য কাগজে ১০ ডলার দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ডলার ছাড়ানো হতো। অতিরিক্ত অংশ বিদেশে থেকে যেত, যা মূলত পাচার। দুর্বল শুল্কায়ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির ঘাটতি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে এটি বছরের পর বছর চলেছে। এতে রিজার্ভ দ্রুত ক্ষয় হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এর প্রধান সহযোগী ছিলেন কাজী সাইদুর রহমান।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু কর্মকর্তা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা পড়লেও কাজী সাইদুরের ব্যপারে তেমন কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।
সর্বশেষ তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ, অর্থপাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিষয়ে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। অনুসন্ধানে কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই তালিকায় কাজী সাইদুর রহমানও রয়েছেন।
দুদক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও মো. আব্দুর রউফ তালুকদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে। সংস্থার আতশি কাঁচে রয়েছেন ডেপুটি গভর্নর মোছা. নুরুন্নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, কাজী সাইদুর রহমান, উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের, নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস, পরিচালক ইমাম আবু সাঈদ, পরিচালক (এফপিআইবি) সরোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত পরিচালক আবদুর রউফ, মঞ্জুর হোসেন খান, মহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন, যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, জোবায়ের হোসেন, নিক তালুকদার, রুবেল চৌধুরী, লেলিন আজাদ পলাশ, উপমহাব্যবস্থাপক তরুণ কান্তি ঘোষ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদৌস কবির, পদস্থ কর্মকর্তা এ বি এম মোবারক হোসেন, উপপরিচালক হামিদুল আলম সখা, সহকারী পরিচালক মো. কাদের ও সহকারী ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন।
দুদকের তালিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, খুরশিদ আলম, সাবেক পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ, সাবেক উপপরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বরখাস্ত) সিকদার লিয়াকত ছাড়াও বিএফআইইউয়ের তিন অতিরিক্ত পরিচালক, দুই যুগ্ম পরিচালক ও এক উপপরিচালক রয়েছেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স