উপেক্ষিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা
জাল সনদে বহাল তবিয়তে সোনালী লাইফের রফিকুল ইসলাম
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৯-১১-২০২৫ ১২:৪২:৩২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৯-১১-২০২৫ ১২:৪২:৩২ অপরাহ্ন
মো. ইমরান খান: শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদে
মো. ইমরান খান: শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে নিয়োগ পান রফিকুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, জালিয়াতির সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠার পরও বিমা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এখনো অবৈধভাবে বহাল রয়েছেন কোম্পানির সিইও হিসেবে।
জানা যায়, রফিকুল ইসলামের ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি- দুটি সার্টিফিকেটই ভুয়া। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে। এ বিষয়ে স্বয়ং অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সম্প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেওয়া হয় কর্তৃপক্ষকে। সেই নির্দেশকে উপেক্ষা করেই বহাল তবিয়তে আছেন রফিকুল ইসলাম।
বিদ্যমান বীমা আইন, ২০১০ এর ৮০(৪) ধারা অনুয়ায়ি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে একাধারে ৩ মাসের অধিক সময়ের জন্য শূন্য পদ রাখার বিধান নেই। তবে আইডিআরএ অপরিহার্য় পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সময়সীমা আরো ৩ মাস বাড়াতে পারে। কিন্তু বছর শেষ হতে চললেও অবৈধভাবে টিকে আছেন রফিকুল। অদৃশ্য কারণে এখনো বীমা আইনের বাস্তবায়ন হয়নি সোনালী লাইফে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দেওয়া গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রফিকুল ইসলাম ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর এই পদে বসেন। এরপর কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এখনো একই পদে বহাল আছেন তিনি।
আইন লংঘন করে চলতি দায়িত্ব পালনকারী দেশের বেসরকারি খাতের কয়েকটি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ৪ জুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর এই সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়।
সূত্র জানায়, বীমা কোম্পানিগুলোতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে মাঠে নেমেছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সে কাজের ধারাবাহিকতায় এনএসআই সম্প্রতি এক তদন্ত করে প্রতিবেদন পেশ করে। চলতি দায়িত্বে থাকা এই সিইওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রেরিত চিঠিতে মতামত পর্বে বলা হয়- আইন লংঘন করে চলতি দায়িত্ব পালনকারী সিইও এবং বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কঠোর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না- তা প্রতীয়মান। বরং নিয়ন্ত্রক আইডিআরএ’র এ ধরনের কার্যক্রম বীমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতিতে উৎসাহিত করছে। কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান কোম্পানি থেকে স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের অনুগত ব্যক্তিদের সিইও পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে। অনুগত ব্যক্তি যোগ্য না হলেও তার জন্য জরিমানা দিয়ে বছরের পর বছর সিইও পদে বহাল রাখা হয়। জরিমানার এ টাকা বীমা গ্রাহকের। ফলে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি বীমা খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে।
এর আগে রফিকুল ইসলামের জাল সার্টিফিকেটের ব্যাপারে আইডিআরএকে চিঠিও দিয়েছিলেন সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তৎকালীন প্রশাসক। আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মো. রফিকুল ইসলামকে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সিইও হিসাবে অনুমোদনের ফাইল আইডিআরএ- তে পাঠানো হয়। সে সময় তাঁর ডিগ্রি ও মাস্টার্স এর দুইটি সার্টিফিকেট জাল- তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। প্রশাসক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এস এম ফেরদৌস (অব:) ফাইল চেক করার পর বিষয়টি ধরা পরে। কারণ তার ডিগ্রি ও মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, সেশন ও সাল একই।’
‘দুইটি সার্টিফিকেট জাল’ উল্লেখ করে সোনালী লাইফের মানব সম্পদ বিভাগের এজিএম রাফি-উর-জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে- আইডিআরএকে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে প্রশাসকের পক্ষ থেকে স্থানীয় থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি মামলার নির্দেশনা দেয়া হয় বলেও জানানো হয়।
এদিকে রফিকুল ইসলামের এসএসসি, এইচএসসি, অর্নাস এবং মাস্টার্সের শিক্ষা সনদ এসেছে শীর্ষনিউজ ডটকমের কাছে। যাচাই-বাচাই করে প্রতিটি সনদেই অসংগতি পাওয়া গেছে। শিক্ষা সনদের পাশাপাশি রফিকের বাবার নামেও ত্রুটি রয়েছে। রফিকুল ইসলাম ১৯৯২ সালে ‘সুধীর কুমার উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে এসএসসি পাশ করেন। সেখানে তাঁর নাম লিখা হয়েছে ‘মো. রফিকুল ইসলাম’ এবং পিতার নাম লিখা হয়েছে ‘মৃত ইমাজ উদ্দিন’। অন্যদিকে সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাশ করা তাঁর এইচএসসির সার্টিফিকেটে নাম ‘মোহা: রফিকুল ইসলাম’ এবং পিতার নাম ‘মৃত ইয়াজ উদ্দিন’ লিখা হয়েছে। এছাড়াও ডিগ্রি ও মাস্টার্সের শিক্ষা সনদেও রয়েছে অসঙ্গতি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনার্সের প্রভিশনাল সার্টিফিকেটে রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার- ২৮৯৫৩, সেশন- ১৯৯৫-৯৬ এবং সার্টিফিকেট ইস্যুর তারিখ ০১-০৩-০৫ উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে মাস্টার্স এর শিক্ষা সনদেও রেজিস্ট্রেশন নাম্বার- ২৮৯৫৩, সেশন- ১৯৯৫-৯৬ ও সার্টিফিকেট ইস্যুর তারিখ ০১-০৩-০৫ উল্লেখ করা হয়। এমনকি মাস্টার্স এর সনদে পরীক্ষার ‘সন’ এর স্থানের কলম দিয়ে কাটা ছেঁড়া রয়েছে। অনার্স এবং মাস্টার্সের পাশের একই সন ‘২০০০’ বলে উল্লেখ রয়েছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, একই শিক্ষাবর্ষে অনার্স এবং মাস্টার্স একই সময়ে করার সুযোগ নেই। সেই হিসেবে পাশের সাল কোনো ক্রমেই এক হতে পারে না। এছাড়াও একই ব্যক্তির নাম ভুল এবং বাবার নাম ভিন্ন হয় কি করে- সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর সিইও মো. রফিকুল ইসলামকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
রফিকুল ইসলামের বিষয়ে জানতে আইডিআরএর আইন বিভাগের পরিচালক মোহাঃ আব্দুল মজিদকে ফোন করা হলে শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, এসব বিষয়ে তার কথা বলার অনুমতি নেই। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তিনি কথা বলবেন। তিনি আরও বলেন, এসব বিষয়ে জানার জন্য আইডিআরএ’র মুখপাত্রের সাথে কথা বলতে হবে।
নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র সাইফুন নাহার শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, জাল সনদে সিইও হিসেবে চাকরি করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, রফিকুল ইসলামের শিক্ষা সনদের ব্যাপারে তিনি অবগত নন, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পরবর্তীতে জানাবেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স