এ’ গ্রেডের নামে ‘সি-ডি’ গ্রেডের লিফট
এ’ গ্রেডের নামে ‘সি-ডি’ গ্রেডের লিফট, আত্মসাৎ সাত কোটি টাকা! চট্টগ্রাম বন্দরে লিফট কেলেঙ্কারি: ‘
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৯-১১-২০২৫ ০৪:০৪:৫৪ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৯-১১-২০২৫ ০৪:০৪:৫৪ অপরাহ্ন
সি’ ও ‘ডি’ গ্রেডের লিফট।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগে লিফট কেনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। সম্প্রতি অন্তত ছয়টি প্রকল্পে নিম্নমানের লিফট সরবরাহ করে এই চক্র কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। টেন্ডারে ‘এ’ গ্রেড লিফটের শর্ত থাকলেও সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ও ‘ডি’ গ্রেডের লিফট।
দরপত্রে প্রতিটি লিফটের দাম ধরা হয়েছিল প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা, কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ করা লিফটগুলোর বাজারমূল্য মাত্র ১৮ লাখ টাকার মতো। অর্থাৎ, নিম্নমানের এসব লিফট সরবরাহের মাধ্যমে ছয়টি প্রকল্প থেকে সাত কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে—এমন তথ্য মিলেছে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে।
🔸 সিন্ডিকেটের পেছনে বন্দর কর্মকর্তারা
দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন—বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক এসএম সাইফুল ইসলাম, উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক এমপি আলি আজগর ও সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের ব্যক্তিগত সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ।
তারা বন্দরে একটি শক্তিশালী চক্র তৈরি করে নির্দিষ্ট ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে নিয়মবহির্ভূতভাবে সুবিধা নিশ্চিত করেছেন।
সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী লিফট কেনা উচিত ছিল ‘গুডস’ (পণ্য) শ্রেণিতে, যেখানে আন্তর্জাতিক মান যাচাই বাধ্যতামূলক। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডারগুলোকে ‘ওয়ার্কস’ (নির্মাণকাজ) শ্রেণিতে দেখিয়ে সেই বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যায়।
🔸 ‘এ’ গ্রেডের কথা, বাস্তবে চায়না লিফট
২০২২ সালে বন্দরের চার নম্বর গেটের ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসিং বিল্ডিং’-এর জন্য চারটি ‘এ’ গ্রেডের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের লিফট সরবরাহের শর্তে টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
চুক্তিমূল্য ছিল ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
কিন্তু সরবরাহ করা হয় চীনের নিম্নমানের ফুজাও ব্র্যান্ডের লিফট, যার দাম বাজারে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকা।
একইভাবে অফিসার্স কোয়ার্টার, ডরমিটরি, স্টোর ভবন ও প্রশাসনিক ভবনেও ‘এ’ গ্রেডের নামে ‘বি-সি’ গ্রেডের লিফট বসানো হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে গড়ে ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
🔸 সিন্ডিকেটে জড়িত প্রতিষ্ঠান
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল, ম্যাক্সওয়েল, সিমেন্স পাওয়ার প্লাস, এবিএম ওয়াটার কোম্পানি ও গ্রিন ডট—সবগুলোই একই সিন্ডিকেটের অধীনে কাজ করে।
এই প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. শাখাওয়াত হোসেন ও আতাউল করিম সেলিম।
বন্দরের টেন্ডারে আগেই ঠিক করে রাখা হয় কে কাজটি পাবে—বাকি ঠিকাদাররা শুধু নামমাত্র দরপত্র জমা দেন।
🔸 প্রকৌশলীদের উদ্বেগ ও পরামর্শ
গণপূর্ত অধিদপ্তরের তিনজন সিনিয়র প্রকৌশলী জানান, ‘এ’ গ্রেড লিফটে থাকা উচিত ইউরোপীয় সার্টিফায়েড কন্ট্রোল ইউনিট, কার্বন-স্টিল সাসপেনশন রোপ ও গিয়ারলেস মোটর। কিন্তু বন্দরে স্থাপিত লিফটগুলো এসব মানদণ্ডের কিছুই পূরণ করেনি।
তাদের মতে, বিষয়টি জীবন ঝুঁকির কারণও হতে পারে।
তারা দাবি করেছেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাইরে একটি স্বাধীন টেকনিক্যাল অডিট টিম গঠন করে সরবরাহকৃত লিফটগুলোর মান যাচাই করতে হবে।
🔸 দুর্নীতি তদন্তের দাবি
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন,
“দরপত্রে এক কোটি ১৫ লাখ টাকার লিফট চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ টাকার লিফট। বাকি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির দৃষ্টান্ত।”
তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে বিষয়টি গভীরভাবে তদন্তের আহ্বান জানান।
🔸 কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া
ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম ফোনে বলেন,
“কোন ধরনের লিফট সরবরাহ করা হয়েছে, সেটা প্রকৌশলীরাই ভালো জানবেন।”
এরপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন তিনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক এসএম সাইফুল ইসলাম বলেন,
“সরেজমিনে দেখে তারপর প্রতিবেদন লিখুন।”
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পারসোনাল অফিসার মো. নাসির উদ্দিন বলেন,
“এ ধরনের ঘটনা ভয়াবহ দুর্নীতিরই অংশ। আমরা অবশ্যই তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স