মাদারীপুরে বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি টাকার পুকুর চুরি, অনিয়মের পাহাড়
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১০-১১-২০২৫ ০৪:৩৯:৫১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১০-১১-২০২৫ ০৪:৩৯:৫১ অপরাহ্ন
মাদারীপুর সদর উপজেলার
মাদারীপুর সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচি (কাবিখা, কাবিটা) এবং ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ অর্থ থেকে নানা উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। রাস্তা মেরামত, ছোট বক্স কালভার্ট, মসজিদ–মন্দির সংস্কার, কবরস্থানের মাটি ভরাটসহ কোনো ক্ষেত্রেই অনিয়মের বাইরে নেই।
সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা ভয়–চাপে মুখ খুলতে পারছেন না, আর সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহে গিয়ে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা কাজ না করেই লোপাট হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ১৫ ইউনিয়নে ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ থেকে তিন ধাপে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি টাকা। একই সময়ে কাবিখায় বরাদ্দ ছিল ১৬৬.২৬৩ মেট্রিক টন গম ও একই পরিমাণ চাল। চালের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৩২ টাকা এবং গমের মূল্য ৭৬ লাখ ৪১ হাজার ৩৩৬ টাকা। নগদ বরাদ্দও ছিল ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯১২ টাকা। সব মিলিয়ে কাবিখা, কাবিটা এবং ১ শতাংশ প্রকল্পে মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ৭ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৬ টাকা।
তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই বিপুল বরাদ্দের এক–তৃতীয়াংশ কাজও বাস্তবে সম্পন্ন হয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠছে কোটি কোটি টাকা গেল কোথায়?
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানোর পর বরাদ্দ পেতে সংশ্লিষ্টদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। পরে প্রকল্প হাতে পাওয়ার পর শুরু হয় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক তৈরি না হওয়া সড়ক, কাজহীন কবরস্থান উন্নয়ন, দ্বৈত বরাদ্দ, নামমাত্র কাজ আর বিল উত্তোলনের ঘটনা।
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নয়ন কিংবা কালভার্ট–ড্রেনেজ সংস্কার কোথাও প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি। উল্টো অর্থ আত্মসাতের এই প্রবাহ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেক ওয়ার্ডের মেম্বার পর্যন্ত জানেন না তাদের এলাকায় প্রকল্প বরাদ্দের বিষয়টি, কিন্তু নথিতে দেখা যাচ্ছে বিল উত্তোলন অনেক আগেই হয়ে গেছে।
শিরখাড়া ইউনিয়নের জটিল চিত্র
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. কবিরউদ্দিন হাওলাদারের স্ত্রী’র নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনটি ওয়ার্ডের একাধিক প্রকল্পের বিল ওঠানো হয়েছে, কিন্তু কাজের অস্তিত্ব নেই। জুলাই বিপ্লবের পর এখানে ১১ মাস চেয়ারম্যান না থাকলেও আর্থিক লেনদেন এবং প্রকল্প বিল উত্তোলন থেমে থাকেনি। সচিব কবির উদ্দিন এখানে ১৫ বছর ধরে কর্মরত, যদিও তার বদলির আদেশ একাধিকবার হয়েছিল। যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
১ নম্বর ওয়ার্ডে একটি পারিবারিক কবরস্থানের নাম ‘গণকবর’ দেখিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫.৬ মেট্রিক টন চাল, যার মূল্য ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এলাকাবাসী জানায়, সেখানে কখনো গণকবর ছিল না, সবই আত্মসাতের উদ্দেশ্যে দেখানো হয়েছে।
অব্যবহৃত বরাদ্দ ও অদৃশ্য রাস্তা
মস্তফাপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বছরের পর বছর ধরে চলাচলের অনুপযোগী। স্থানীয়দের নিজস্ব মাটি ফেলে পথ তৈরির পরও সরকারি কোনো কাজ হয়নি। অথচ সেই রাস্তায় ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা এবং ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আরো ৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। দুবার বরাদ্দ, দুবার বিল উত্তোলন, কিন্তু রাস্তার কোনো উন্নয়ন নেই।
একইভাবে কুনিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ইটের রাস্তা আগে থেকেই তৈরি থাকা সত্ত্বেও সেটিকে মাটির রাস্তা দেখিয়ে ৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এলাকাবাসী দাবি করে, বরাদ্দের টাকা ব্যবহারের কোনো চিহ্ন নেই।
পাঁচখোলা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে যে রাস্তায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ আছে, বাস্তবে সেখানে এমন কোনো রাস্তা বা ঐ নামে কোনো ব্যক্তি নেই বলেও স্থানীয়রা জানান।
ত্রুটিপূর্ণ ঠিকানা, দুই ইউনিয়নে একই প্রকল্প সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, খোয়াজপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে যেই রাস্তায় ইটের সলিংয়ের জন্য ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ, একই ঠিকানা দেখিয়ে পাঁচখোলা ইউনিয়নেও বরাদ্দ দেওয়া হয় আরো ৫ লাখ টাকা। কাজ নেই, কিন্তু টাকা উত্তোলন হয়েছে।
দুদকের অভিযান অভিযোগ বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে জানান। দুদক অভিযোগ পেয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস এবং এলজিইডি অফিসে অভিযান চালায়। নথিপত্র যাচাই করে ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১১টিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান দুদকের উপপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্তারিত বলতে হলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।’ অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন দাবি করেন।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. হাবিবুল আলম জানান, তদন্ত চলছে। একই রাস্তায় দ্বৈত বরাদ্দ পাওয়া গেলে প্রকল্প বাতিল করে অর্থ ফেরত নেওয়া হবে। যেখানে কাজ হয়নি, সেসব প্রকল্প শনাক্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স