ঢাকা , বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫ , ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রাণিসম্পদের ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের শেষ নেই

​অনুমোদন ছাড়াই ব্যয় ৩৬ কোটি আবদার আরও ১০১ কোটি

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১২-১১-২০২৫ ০৩:৫২:৪৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১২-১১-২০২৫ ০৩:৫২:৪৮ অপরাহ্ন
​অনুমোদন ছাড়াই ব্যয় ৩৬ কোটি আবদার আরও ১০১ কোটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের
সরকার অনুমোদিত সীমার বাইরে গিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি বড় প্রকল্পে অত্যধিক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২১টি খাতে মোট ৩৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এই ব্যয়ের কোনো অনুমোদন ছিল না। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে অনুমোদনহীন এই ব্যয়ের বৈধতা চাওয়া হয়েছে, যা সরকারি প্রকল্প পরিচালনা নির্দেশিকার পরিপন্থি। এমনকি কোনো যৌক্তিকতা ছাড়াই ওই সব খাতে আরও ১০১ কোটি টাকা চেয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

আলোচ্য প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও সংশোধন নির্দেশিকা অনুযায়ী কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অনুমোদন ছাড়া ব্যয় করা যায় না।

অর্থাৎ অনুমোদনের আগেই অতিরিক্ত ব্যয় করা অনিয়ম।

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশীদ কালবেলাকে বলেন, অনুমোদন ছাড়া ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই, এটা অন্যায়। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধ বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবের যেসব খাতে অযৌক্তিক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে সেগুলো বাদ দিতে হবে। অযৌক্তিক প্রস্তাবের বিষয়ে শুধু প্রশ্ন তুললেই হবে না, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের অনিয়ম চলতেই থাকবে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই প্রকল্পটি প্রথমে ২০১৯ থেকে ২০২৩ মেয়াদে ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকায় অনুমোদন পায়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা এবং মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়। এবার দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় কমিয়ে ৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় আনার প্রস্তাব করা হলেও প্রকল্পের একাধিক খাতে অনুমোদন ছাড়াই ব্যাপক ব্যয় হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও অব্যয়িত টাকার পরও নতুন বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যা পরস্পরবিরোধী বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটিতে ৬০টি খাতে নতুনভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ এর মধ্যে ২১টি খাতে এরই মধ্যে ৩৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে গেছে, আবার সেই খাতগুলোতেই আরও ১০১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এখনো টাকা ব্যয় শুরু না করেও নতুন অর্থের দাবি জানানো হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই প্রকল্পের যেন অনিয়মের শেষ নেই। সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী আলোচ্য প্রকল্পে উপজেলা পর্যায়ে মার্কেট উন্নয়ন খাতে এরই মধ্যে ১৩৫টি মার্কেট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধনীতে একই কাজের জন্য ২৫৩ কোটি টাকার নতুন বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, অতিরিক্ত ৪২ কোটি টাকা কোথায় ব্যয় হবে, তা উল্লেখ নেই। একইভাবে, ‘স্লটার হাউস নির্মাণ’ খাতে ১৩টি হাউস নির্মাণ সম্পন্ন হলেও নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে আরও ১৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা হয়েছে, যা পরিকল্পনা কমিশনের মতে একেবারেই অযৌক্তিক।

প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ‘অফিস কনটিনজেন্সি’ খাতে ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার মধ্যে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে, তবু আরও ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ‘কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জাম’ খাতে ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, অথচ নতুন সংশোধনীতে আবারও ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বাড়তি চাওয়া হয়েছে। এই খাতগুলোতে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধিকে কমিশন ‘অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

এদিকে, মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট থেকেই প্রতি বছর বিশ্ব দুগ্ধ দিবস পালন করা হয়। তবু ‘ডেইরি উইক’ খাতে ৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সীমা ছাড়িয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘লাইভস্টক এক্সিবিশন’ খাতে ৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, অর্থাৎ অবশিষ্ট প্রায় ১৩ কোটি টাকা থাকার পরও ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, ‘মোবাইল ভেটেরিনারি সার্ভিস’ খাতে ২৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ২৯৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, অর্থাৎ এরই মধ্যে অনুমোদনের চেয়ে ১১ কোটি টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে। তবু আরও ৪২ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি নতুন যানবাহন (৫৩টি ভেটেরিনারি ক্লিনিক ও একটি কুলিং ভ্যান) কেনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রকল্পের শেষ বছরে এত গাড়ি কিনে কীভাবে সেগুলো মেনটেইন্যান্স করা হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আলোচ্য প্রকল্পে বর্তমানে মাত্র পাঁচজন পরামর্শক কর্মরত, অথচ এ খাতে এরই মধ্যে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। এখন আবার আরও ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেখানে অধিকাংশ পরামর্শকের মেয়াদ শেষ, সেখানে নতুন করে এত অর্থের প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্নের মুখে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, উপজেলা পর্যায়ে মিনি ডায়াগনস্টিক ল্যাব নির্মাণে অতিরিক্ত ৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং জেলা পর্যায়ের পশু চিকিৎসা অবকাঠামোতে আরও ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশনের প্রশ্ন, এত অল্প সময়ে এসব অবকাঠামো নির্মাণ ও সরঞ্জাম সংগ্রহ আদৌ সম্ভব কি না? একইভাবে, প্রকল্প ভবন নির্মাণে আয়তন ও ব্যয়ের গরমিলও ধরা পড়েছে। টেন্ডারে যেখানে ৫৬৫ বর্গমিটার ভবনের কথা বলা হয়েছে, ব্যয় বিভাজনে দেখানো হয়েছে ১৪১৫ বর্গমিটার। অর্থাৎ বড় আয়তনের ভবনের টাকা দিয়ে ছোট ভবন করে পুরো টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আলোচ্য প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অনুমোদনহীন ব্যয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে অযৌক্তিক ব্যয়ের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

প্রকল্প পর্যালোচনায় কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্পে ব্যয় কমানোর নামে সংশোধনী আনলেও বাস্তবে প্রকল্পের ভেতরে চলছে অযৌক্তিক খরচের উৎসব। অনুমোদন ছাড়াই শত শত কোটি টাকা ব্যয়, বিশ্বব্যাংকের সম্মতি ছাড়া নতুন ব্যয় প্রস্তাব এবং ব্যয়ের গরমিল—সব মিলিয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প এখন পরিণত হয়েছে সরকারি প্রকল্পে অপচয়ের এক বড় উদাহরণ।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মোস্তাফিজুর রহমান  বলেন, অপ্রয়োজনীয় ও যেগুলো প্রকল্প মেয়াদে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, সেগুলো বাদ দিয়ে প্রকল্প সংশোধন করতে বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় কোনো ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হবে না।

নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ