ঢাকা , বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫ , ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​অফিস সময় শেষে শুরু অনিয়মের অফিস

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১৬-১১-২০২৫ ১২:৪৬:১৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৬-১১-২০২৫ ১২:৪৬:১৯ অপরাহ্ন
​অফিস সময় শেষে শুরু অনিয়মের অফিস জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বহির্গমন শাখা মূলত বিদেশগামী কর্মীদের নিরাপদ, বৈধ ও সুশৃঙ্খল কর্মসংস্থানের দায়িত্বে নিয়োজিত। এ শাখাটি ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এবং প্রতিটি ফাইল যাচাই হয় নিয়মমাফিক। কিন্তু অফিসের নির্ধারিত সময় শেষ হতেই চিত্র বদলে যায়। সন্ধ্যা নামতেই সরগরম হয়ে ওঠে নানা এজেন্সির লোকদের আনাগোনায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে অসাধু সিন্ডিকেট। অনেকক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে নিজেরাই কাজ সারেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। এক দিনে ৭৯টি ফাইল অনুমোদন, জাল ও এডিটেড পাসপোর্ট দিয়ে ছাড়পত্র—এসব কার্যক্রমের প্রমাণ রয়েছে। অনেক এজেন্সির সৌদিতে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন নেই, তবুও তারা অসংখ্য শ্রমিক পাঠিয়েছে। সহায়সম্বল বিক্রি করে স্বপ্ন দেখা প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশের ফলে নাগরিকদের তথ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। নিয়ম, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার মুখোশের আড়ালে এ অনিয়মের আসর চলছেই।

বিএমইটির বহির্গমন শাখা বৈধ চুক্তিপত্র যাচাই করে বিদেশগামী কর্মীদের ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে। তাদের ক্লিয়ারেন্স না পেলে কেউ বিদেশে কাজ করতে যেতে পারেন না। রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যক্রম তদারকি, চুক্তির শর্ত বিশ্লেষণ ও কর্মীদের অধিকার রক্ষাও এ শাখার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রত্যেক বিদেশগামী কর্মীর তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে, যাতে ভবিষ্যতে সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া সহজ হয়। প্রতারণা বা জাল কাগজপত্র শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণও বহির্গমন শাখার কাজের অংশ। অনলাইন সেবার মাধ্যমে সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বহির্গমন ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা হয়। এজন্যই এ অতিগুরুত্বপূর্ণ শাখাটি প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত বা ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বহির্গমন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে তা জানানোরও একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় রয়েছে। বহির্গমন শাখার একজন কর্মকর্তা দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বিএমইটির প্রশাসনিক ভবনে বসে সবার অভিযোগ শোনেন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন।

তবে কালবেলার অনুসন্ধানে বলছে, এসব নিয়মকানুন শুধু যারা বৈধভাবে কাজ করে, তাদের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যদিকে, একটি অসাধু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এসব নিয়মকানুন না মেনে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করে। এমনকি এ প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ কক্ষে তারা অবাধে প্রবেশ করেন। অফিস টাইম শেষে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সিন্ডিকেটের লোকজন। অবাধে প্রবেশ করে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ার-টেবিলে বসে নিজেরাই নিজেদের কাজ সম্পন্ন করেন। কোনো ধরনের নিয়ম-কানুন না মেনে তারা অনুমোদন করান নিজেদের ফাইল। আর চক্রটির সঙ্গে বিএমইটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত থাকায় তদারকিও কার্যকর হয় না। এর ফলেই বিদেশে পাড়ি জমানো শ্রমিকরা প্রতিনিয়িত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এর বাইরেও সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশের কারণে নাগরিকদের তথ্য অনিরাপদ হওয়ার প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এমন বেশকিছু ভিডিও কালবেলার হাতে রয়েছে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বিভিন্ন সময়ে ওই ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, টি-২০ ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১৪১৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান আক্তার ‘প্রবেশ নিষেধ’ বহির্গমন শাখা থেকে বের হচ্ছেন। এ নুরজাহানের বিরুদ্ধে বিএমইটিতে নানা প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক মামলা রয়েছে। আর একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে দি ইফতি ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ৮৯৪) ব্যবস্থাপনা অংশীদার মো. রুবেল বহির্গমন শাখার প্রবেশ করছেন। এ সময় দরজার সামনে থাকা প্রহরী তাকে দরজা খুলে দেন। তাকওয়াহ ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১৯৪৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিমকে বহির্গমন শাখার ভেতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বিএমইটিতে আধিপত্য রয়েছে এমএস মক্কা ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১১৭৫) মো. জামাল হোসেন ও মিজান সলিউশন সার্ভিসের (আরএল নম্বর: ২৭৭৮) মো. মিজানুর রহমানের।

অনুসন্ধানে এসব এজেন্সির ইতিহাস খুঁজে নিয়মকানুন না মেনে শত শত কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে কালবেলা। এর মধ্যে মিজান সলিউশনের সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর অনুমোদনই নেই। তবু তিনি অসংখ্য কর্মীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন কিছু কর্মীর পাসপোর্ট নম্বর হলো এ০১২০৯৪৬৬, এ১৪৪৭৪৪৩, এ০২৮৪২২৮০, এ০৩৭৬৮৪৮৩, এ০৫০৯০৪১১, এ০৫৯৮৬২৭৮, এ০৬৫৭৪৫৬৩, এ০৭৩২৪০৮৭, এ০৭৯৯১৫০২, এ০৮৬১৩৫৬০, এ০৮৬১৯৬০৭, এ০৮৯২৪৩৫৯, এ১২৪৮২৪৫৭, এ১৫৩১৮৭৯০, এ১৫৬৭২৬৬৭, এ১৬০৯৯৬৯০, এ১৬১২০৪৮৩, এ১৬২২৪৫৪৭, এ১৬৪৯৩৭৯২, এ১৬৮৯০২২৮, ইজে০৮৩৩৩৪১ ও ইএল০৭২৩২০১।

এ বিষয়ে মিজান সলিউশন সার্ভিসের মো. মিজানুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে কে বা কারা কাজ করেছে আমি জানি না। আমি নিজে সৌদি আরবে কোনো লোক পাঠাইনি। যারা এ কাজ করেছে, আমি তাদের খুঁজতেছি।’

চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি আপনার লাইসেন্স থেকে ২২ জন কর্মী সৌদি আরবের ছাড়পত্র পেল কীভাবে, এটি কে করেছে—এমন প্রশ্নে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। আপনার লাইসেন্সের আইডি পাসওয়ার্ড তো আপনার কাছেই থাকে, তাহলে অন্য লোক কীভাবে পাঠালো—এমন প্রশ্নে মিজানুর রহমান বলেন, ‘সেটাই তো কথা। আমি তাদের খুঁজতেছি, যারা এ কাজ করল।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএমইটিকেন্দ্রিক অসাধু সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক টি-২০ ওভারসিজের নুরজাহান আক্তার ও দি ইফতি ওভারসিজের মো. রুবেল। তারা নিজেদের এজেন্সির বাইরেও অন্তত ৫০টি এজেন্সির হয়ে কাজ (দালালি) করেন। নুরজাহান আক্তার ছিলেন বিএমইটির সাবেক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। বিএমইটিতে চাকরিকালীন তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে। এরপর দুদকের একটি মামলার চাকরি হারান। চাকরি হারিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন নুরজাহান। বিএমইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য করে গড়ে তোলেন ভয়ংকর মানব পাচার চক্র। নিয়ম না মেনে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছেন—এমন কিছু শ্রমিকের পাসপোর্ট নম্বর হলো এ০৮৪৩৮১৫০, এ১৩৪৮৯১৭৫, এ১৭৯৫১৮০৮, এ১৭৮১০৬৯০ ও এ১৭৯১৩৪৯৭।

অভিযোগের বিষয়ে নুরজাহান আক্তারকে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

এই চক্রে নুরজাহানের অন্যতম সহযোগী দি ইফতি ওভারসিজের মো. রুবেল। বিএমইটিতে দুজনরেই রয়েছে অবাধ যাতায়াত। অন্যান্য এজেন্সি নিয়ম মেনে কাজ করতে গেলে তাদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। অথচ নুরজাহান-রুবেল নিজেরাই বহির্গমন শাখায় গিয়ে দিনে দিনে তাদের কাজ করিয়ে নেন। যেমন গত ২০ মে একই দিনে নুরজাহান আক্তারের ৭৯টি ফাইল অনুমোদন (অ্যাপ্রোভ) করা হয়। একইভাবে গত ১৭ মার্চ রুবেলের দি ইফতি ওভারসিজ থেকে একইদিনে অ্যাপ্রোভ করা হয়েছে ২০টি ফাইল। এ ছাড়া ইফতি ওভারসিজের মাধ্যমে ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে এডিট করা পাসপোর্ট দিয়েও নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে কালবেলা। এমন কিছু পাসপোর্ট নম্বর হলো এ১১৫০০৬৩৭, এ১৪৭০৪৮৩২, বিআর০৮৬৯৮০২, এ১৭৪০৫৫৫১, একে০৬৯৯৩৪৫ ও ইকে০২৫১১৭২।

জানতে চাইলে মো. রুবেল বলেন, ‘আমি অন্য কোনো লাইসেন্সে কাজ করি না। এ অভিযোগ মিথ্যা।’ তবে বহির্গমন শাখায় ঢোকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের প্রয়োজনে আমরা ডিরেক্টর স্যারের অনুমতি নিয়ে যাই। আমরা নিচে গিয়ে ফোন দিই, এরপর ডিরেক্টর স্যার বললে ভেতরে যাই।’

রুবেলের বক্তব্যের সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হয় বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালক (উপসচিব) মো. তাজিম-উর-রহমানের সঙ্গে। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো সুযোগ নেই। আমাদের গেটম্যানটা দুষ্ট একটা গেটম্যান। যে কারণেই গেটম্যানকে বদলি করা হয়েছে। আমি আগামী রোববারই (২১ সেপ্টেম্বর) আবার গেটম্যানকে ডাকাব।’

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এমএস মক্কা ওভারসিজের গত ১৯ মার্চ অ্যাপ্রোভ করা হয়েছে ৯টি ফাইল। এ এজেন্সির বিরুদ্ধেও জাল ও ভুয়া এডিট করা পাসপোর্টে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। মক্কা ওভারসিজের মো. জামাল হোসেন জানান, তারা সব নিয়ম মেনেই কাজ করেন। এরপর বেশ কয়েকটি এডিটেড পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো হওয়ার কথা নয়। এগুলো কীভাবে হলো আমি বুঝতে পারছি না।’ এরপর তিনি উল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি এগুলো কীভাবে পাইলেন?’

একই অভিযোগ তাকওয়াহ ওভারসিজের বিরুদ্ধে। সবমিলিয়ে এ পাঁচটি এজেন্সির নিয়মবহির্ভূতভাবে অ্যাপ্রোভ করা শতাধিক পাসপোর্ট রয়েছে কালবেলার হাতে। অভিযোগের বিষয়ে তাকওয়াহ ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিমকে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে বিএমইটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিএমইটিতে সবচেয়ে বেপরোয়া নুরজাহান আক্তার। আগে তিনি এখানে চাকরি করেছেন বলে কর্মকর্তারা চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতেও পারেন না। অ্যাপ্রোভ না করলে তিনি কর্মকর্তাদের রুমে গিয়ে বসে থাকেন। দুদক এ নুরজাহানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও করেছে। তবে লাভ হচ্ছে না। এ চক্রকে এখনই থামানো দরকার।’

জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ‘স্পর্শকাতর তথ্য আছে বলেই তো ওই বিভাগটি রেস্ট্রিকটেড করা হয়েছে। এখন রেস্ট্রিকটেড কক্ষে যদি অবাধ যাতায়াত থাকে, তাহলে তো সেটি আর রেস্ট্রিকটেড থাকল না। এরপর সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ার-টেবিলে বসে যদি কিছু মানুষ কাজ করে, তাহলে সেটা আরও অ্যালার্মিং বিষয়। আমি বলব, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে কেউ অবৈধ সুবিধা নিলে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তবে এ ধরনের কাজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া একদমই সম্ভব নয়। অনিয়মের সঙ্গে যদি খোদ কর্মকর্তারাই জড়িত থাকেন, তাহলে ব্যবস্থাটা কে নেবে।’

গত ১ সেপ্টেম্বর বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর নিজ কার্যালয়ে বিস্তারিত শুনে এবং বহির্গমনে ঢোকার ভিডিও দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। তাৎক্ষণিক কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন করে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করারও কথা বলেন।

নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ