অচল করে রেখেছে অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেট
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ-কে অচল করে রেখেছে অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেট
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৮-১১-২০২৫ ০৪:৫৭:০২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৮-১১-২০২৫ ০৪:৫৭:০২ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো বাংলাদেশ ফিনান্সিয়্যাল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই গোয়েন্দা ইউনিটকে সম্পূর্ণ অচল করে রাখা হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে সেই বহুল আলোচিত এস আলম, সালমান এফ রহমান, আজিজ খানসহ অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেট। যারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। অর্থপাচারের সেইসব অপকর্ম ডাকতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে এই চক্রটি। আর তাই চক্রটির প্রধান টার্গেট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়্যাল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট- যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ হলো বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকানো, পাচারের তথ্য উদঘাটন, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে অপরাধীদের আর্থিক লেনদেনগুলো নজরে রাখা।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু এরপরেই বিএফআইইউ’র প্রধান পদে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে একজন যোগ্য কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে গিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম হয়। নিয়োগ পরীক্ষায় যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছেন এদের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও নজিরবিহীনভাবে নিয়োগ দেয়া হয় নিয়োগ পরীক্ষায় ভয়াবহভাবে ফেল করা এমন এক কর্মকর্তাকে, যার বিরুদ্ধে অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থপাচারে সহযোগিতার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অতীতে তার নৈতিক স্খলনজনিত অপকর্মের বিষয়টিও ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তারপরও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সরকারের শীর্ষমহল থেকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম নামের এই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর চেয়ারে বসেই তিনি তার অতীত অপকর্মের সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। প্রকাশ্যে ধান্দা-ফিকির, চাঁদাবাজি, অর্থপাচারকারীদের স্বার্থরক্ষা, এমনকি শেষ পর্যন্ত নৈতিক স্খলনজনিত ভিডিও-ও ভাইরাল হয়। যে কারণে অবশেষে তাকে চাকরি হারাতে হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিএফআইইউ’র প্রধান পদে এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে। নিয়ম অনুযায়ী এরপরেই নতুন আরেকজনকে সংস্থাটির প্রধান পদে নিয়োগ দেয়াটা জরুরি ছিল। এক্ষেত্রে যেহেতু আগে থেকেই নিয়োগ পরীক্ষা হয়ে আছে তাই নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষারও প্রয়োজন হতো না।
কিন্তু, শাহীনুল ইসলামের চুক্তি বাতিলের পর ইতিমধ্যে এক সপ্তা পার হয়ে গেলেও বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নতুন আর কাউকে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয় বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরফলে গুরুত্বপূর্ণ এই গোয়েন্দা ইউনিটটি কার্যতঃ সম্পূর্ণই অচল হয়ে পড়েছে। এরও নেপথ্যে রয়েছে এস আলম, সালমান, আজিজ খানসহ সেই অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেটই। বাংলাদেশের অর্থ লুট ও পাচার করে সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনী হয়েছেন আজিজ খান। এস আলমও সিঙ্গাপুরে বিশাল সুপার মার্কেট কিনেছেন। শুধু সিঙ্গাপুরেই নয়- কানাডা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ নিয়েছেন তিনি। সালমান এফ রহমান জেলে থাকলেও কোনো কিছু তার থেমে নেই। বিশে^র বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থ নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এছাড়া আরো অন্যান্য রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী বড় বড় অর্থপাচারকারীরা তো রয়েছেই। এদের সবারই টার্গেট হলো সরকারের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে অচল করে রাখা। অতীতের মতো এদের প্রধান এজেন্ট হিসেবে এখনো অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ আমলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে এবং এর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবেও এতটা ক্ষমতাবান ছিলেন যে, পুরো আর্থিক খাত ছিল তার হাতের মুঠোয়। এস আলম, সালমান সিন্ডিকেটের প্রধান এজেন্ট হিসেবেই তিনি এতটা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন এবং তাদের হয়েই সব অপকর্ম করতেন আওয়ামী আমলে।
অবাক ব্যাপার হলো, অর্থপাচার চক্রের মূল হোতা কুখ্যাত আব্দুর রউফ তালুকদার এখনো এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন। যদিও দেশের ব্যাংক খাত লুট, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের দায়ে তার এখন জেল-ফাঁসি হওয়ার কথা! নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, কুখ্যাত আব্দুর রউফ তালুকদার দেশের মধ্যেই নিরাপদ স্থানে আছেন। সরকারও তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত আছে। নিরাপদ স্থানে বসেই তিনি অর্থপাচারকারী সিন্ডিকেটের হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গুটি চালছেন। দেশের আর্থিক খাতকে সচল করার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর্থিক খাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক- বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলো অচল করে রেখেছেন। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হতে দিচ্ছেন না। এ কাজে রউফ তালুকদার ব্যবহার করছেন নিজের অনুগত ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব সাইফুল্লাহ পান্না এবং আব্দুর রউফ তালুকদার উভয়ের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত সাইফুল্লাহ পান্না অর্থ মন্ত্রণালয়েই রউফ তালুকদারের সঙ্গে ছিলেন। রউফ তালুকদারই তাকে যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিতে সহায়তা করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সাইফুল্লাহ পান্নাকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব পদে নিয়োগেও নেপথ্য থেকে ভূমিকা রেখেছেন এই আব্দুর রউফ তালুকদারই। ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পর আব্দুর রউফ তালুকদার যদিও পলাতক, কিন্তু পলাতক থেকেই তিনি নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এ কাজগুলো করছেন। এক সময়ের বান্ধবী বলে পরিচিত নাজমা মোবারেককে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদে নিয়োগেও কুখ্যাত আব্দুর রউফই প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। অনুগত সাইফুল্লাহ পান্নাকে দিয়েই তিনি এ কাজটি করেন। গত বছরের ৩০ অক্টোবর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ পান নাজমা মোবারেক। এর আগে সাইফুল্লাহ পান্না অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে ফোনে অনুরোধ করেন, তিনি যেন নাজমা মোবারেককে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব করার জন্য জনপ্রশাসন সচিবকে বলেন। অর্থ উপদেষ্টা জনপ্রশাসন সচিবকে ফোন করেন। এরপরে নাজমা মোবারেকের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। জয়ী হন কুখ্যাত, পলাতক আব্দুর রউফ তালুকদার- আর এর মাধ্যমে এস আলম-সালমান গং।
এরপরে চলতি বছরের শুরুতে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে অবৈধভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই দুই সচিব- সাইফুল্লাহ পান্না এবং নাজমা মোবারেকই মূল ভূমিকা পালন করেন। সরকারের আইন বিষয়ক একজন উপদেষ্টাও এরসঙ্গে ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরীও কলকাঠি নেড়েছেন। এরা মূলতঃ এস আলম, সালমান এবং রউফ তালুকদার গংদের অ্যাসাইনমেন্টই বাস্তবায়ন করেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে শাহীনুল ইসলাম নিজেই অর্থপাচার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন বলে প্রমাণাদি রয়েছে সরকারের হাতেই। বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ফেল করেছেন। তারপরও তাকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। অবশেষে নানা কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে শাহীনুল ইসলামকে বিদায় নিতে হলো।
কিন্তু এখনো সেই একই চক্রই সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটটিকে (বিএফআইইউ) অকার্যকর করে রেখেছে। প্রধান পদে নতুন কাউকে নিয়োগের বিষয়ে টালবাহানা করছে। যদিও নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে আগেই নিয়োগের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়ে আছে। এখন শুধুমাত্র অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রস্তাব উপস্থাপন করলেই ‘প্রধান’ পদে নিয়োগের কাজটি সম্পন্ন করা যায়। অথচ রহস্যজনক কারণে এ বিষয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে। এদিকে বিএফআইইউ’র একটি পরিচালক পদও বর্তমানে শূন্য পড়ে আছে। একজন পরিচালককে নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতির পর নতুন কাউকে এই শূন্য পদে দেয়া হয়নি।
জানা গেছে, গত সপ্তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্যায়ের চারজনকে নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তবে শূন্য হওয়া এসব পদে নতুন কাউকে পদায়ন করা হয়নি। একই সময়ে অতিরিক্ত পরিচালক পর্যায়ের ৪ কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে পদোন্নতিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হলেও এদের কাউকে পদায়ন করা হয়নি। এসব অনিয়মের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো, ডিবিআই (ডিপার্টমেন্ট অব ব্যাংকিং ইন্সপেকশন)-৩। ব্যাংক পরিদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ এ শাখাটির শীর্ষ পদে শূন্যতার কারণে কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এই অচলাবস্থার মধ্যেই ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী গিয়েছিলেন বিদেশ সফরে। দীর্ঘ ১০ দিনের ভারত সফর শেষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফিরেছেন। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলে তিনি এই ১০ দিন ভারতে কাটিয়েছেন। ভারতে ইদানিং আওয়ামী লীগের নানারকমের বৈঠক চলছে। তারমধ্যেই জাকির হোসেন দীর্ঘ ১০ দিন এভাবে ভারতে কাটিয়েছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে কানাঘুষা রয়েছে।
উল্লেখ্য, জাকির হোসেন চৌধুরী ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ আমলে নিজেকে ব্যবসায়ী এস আলমের ভাগ্নি জামাই হিসেবে পরিচয় দিতেন। ব্যাংকপাড়ার সবাই তাকে এভাবেই চিনতো। ইদানিং তিনি এই পরিচয়টা লুকানোর চেষ্টা করলেও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বসেই এস আলমসহ অর্থপাচারকারীদের স্বার্থরক্ষা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স